পরিপাক প্রক্রিয়াটি কতগুলো ধারাবাহিক যান্ত্রিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
১. যান্ত্রিক পরিপাক (Mechanical digestion) : পরিপাকের সময় যে প্রক্রিয়ায় গৃহীত খাদ্যের পরিশোষণযোগ্য অংশ চিরানো, গলাধঃকরণ ও পৌষ্টিকনালি অতিক্রমের সময় নালির বিভিন্ন অংশের পেশল সঞ্চালনের ফলে গাঠনিক ভাঙনের (physical breakdown) মাধ্যমে অতি ক্ষুদ্র টুকরায় পরিণত হয়ে এবং এনজাইমের ক্রিয়াতলের বৃদ্ধি ঘটিয়ে (increases the surface area for the action of the digestive enzymes) সহজ ও সম্ভব করে তোলে তাকে যান্ত্রিক পরিপাক বলে ।)
২. রাসায়নিক পরিপাক (Chemical digestion) : (পরিপাকের সময় গৃহীত খাদ্যের পরিপাকযোগ্য অংশ যান্ত্রিক পরিপাকের পরপরই মুখ, পাকস্থলি ও অস্ত্রে এসিড, ক্ষার ও এনজাইমের সহায়তায় রাসায়নিক ভাঙনের (chemical breakdown) মাধ্যমে দেহকোষের গ্রহণোপযোগী উপাদানে পরিণত হওয়াকে রাসায়নিক পরিপাক বলে। নিচে মানুষের পৌষ্টিকনালির বিভিন্ন অংশে শর্করা, আমিষ ও স্নেহদ্রব্যের পরিপাক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।মুখগহ্বরে খাদ্য পরিপাক (Digestion in Buccal Cavity)
মানুষের পৌষ্টিকনালি মুখ থেকে পায় পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ৮-১০ মিটার লম্বা। পৌষ্টিকনালির শুরু মুখ থেকে। এটি নাসাছিদ্রের নিচে অবস্থিত এক আড়াআড়ি ছিদ্র যা একটি করে উপরের ও নিচের ঠোঁটে বেষ্টিত থাকে। মুখছিদ্রের মাধ্যমে খাদ্যবস্তু মুখগহ্বর বা মুখবিবরে প্রবেশ করে।
মুখপরবর্তী গহ্বরটি মুখগহ্বর। একে ঘিরে এবং এর ভিতরে কয়েকটি অঙ্গ অবস্থিত। এসব অঙ্গের মধ্যে গাল, দাত, মাড়ি, জিহ্বা ও তালু প্রধান। মুখগহ্বরের ঊর্ধ্ব প্রাচীর তালুর অস্থি ও পেশি দিয়ে, সামনের প্রাচীর ঠোঁটের পেশি। দিয়ে এবং পাশের প্রাচীর গালের পেশি নিয়ে গঠিত। তালুর অগ্রভাগ অস্থিনির্মিত ও মধ্যভাগ থেকে একটি মুক্ত, পশ্চাৎভাগ পেশল ও নরম । কোমল তালুর পেছনের প্রান্তের বিশেষ আলজিহ্বা (cpiglottis) মুখগহ্বরে ঝুলে থাকে।
নিম্ন চোয়ালের অস্থির সাথে জিহ্বা যুক্ত থাকে। এর পৃষ্ঠতলে থাকে ফ্লাস্ক আকৃতির স্বাদকোরক বা স্বাদকুঁড়ি (taste bids)। স্বাদকুঁড়িগুলো খাদ্যে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বস্তুর প্রতি সংবেদনশীল। যেমন-জিহ্বার অগ্রপ্রান্তে মিষ্টি গ্রেভাগের দুপাশে নোনা, পশ্চাৎভাগের দুপাশে টক (অম্লতা) এবং পেছন দিকে তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করে। পাঁচ-দশ দিনের মধ্যে খাদ্যের ঘসায় স্বাদকুঁড়ি নষ্ট বা ছিন্ন হয়ে যায় এবং প্রতিস্থাপিত হয়।
মুখগহ্বরে খাদ্যবস্তু দুর্ভাবে পরিপাক হয়- যান্ত্রিক ( mechanical) ও রাসায়নিক (chemical)।
যান্ত্রিক পরিপাক
সামান্যতম স্বাদ, গন্ধ ও খাদ্য গ্রহণে স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্ক যে সংকেত পায় তার প্রেক্ষিতে মস্তিষ্ক লালাগ্রন্থিগুলোতে লালা ক্ষরণের বার্তা পাঠায়। লালা মূলত পানিতে গঠিত এবং খাদ্যকে এমনভাবে নরম ও মসৃণ করে যাতে দাঁতের কাজ দ্রুত ও সহজ হয়।
এ চার ধরনের দাঁত যেমন- ইনসিসর ( Incisor), ক্যানাইন (Canine), প্রিমোপার (Pre-molar) ও মোলার (Molar)-এর নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে বড় খাদ্যখণ্ড কাটা-ছেঁড়া, পেষণ-নিষ্পেষণ শেষে হজম উপযোগী ছোট ছোট টুকরায় পরিণত হয়।
জিহ্বা নড়াচড়া ও সংকোচন-প্রসারণক্ষম পেশল অংশ। এটি স্বাদ নেওয়া ছাড়াও দাঁতে আটকে থাকা খাদ্যকণা সরাতে, মুখের চারপাশে ঘুরিয়ে বিভিন্ন দাঁতের নিচে পৌঁছাতে, লালা মিশ্রণে এবং সবশেষে গিলতে সাহায্য করে। যান্ত্রিক পরিপাকের সময় খাদ্যখণ্ড নিষ্পেষিত হয়ে নরম খাদ্যমও (bolus)-তে পরিণত হয়। জিহ্বার উপরতল যখন খাদ্যমণ্ডকে শক্ত তালুর (hard palate) বিপরীতে রেখে চাপ দেয় তখন খাদ্যমও পেছন দিকে যেতে বাধ্য হয়। T পেছনে কোমল তালু (soft palate) থাকায় খাদ্যপিণ্ড নাসাচ্ছিদ্রপথে প্রবেশে বাঁধা পায় । কোমল তালু পার হলেই খাবার গলবিলে এসে পৌঁছায়। গলবিল থেকে দুটি নালি চলে গেছে- একটি শ্বাসনালি(trachea), অন্যটি অন্ননালি (oesophagus)। আর জিহ্বার গোড়ার দিকে শ্বাসনালির অংশে ছোট উদগত অংশ হিসেবে অবস্থিত আলজিহ্বা (epiglottis) অন্ননালির উপর এমন এক উর্ধ্বগামী বলপ্রয়োগ করে যাতে চিবানো খাদ্য শ্বাসনালির ভিতর প্রবেশ না করে অন্ননালির ভিতর প্রবেশ করে।
দন্ত সংকেত (Dental formula) : স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মোট দাঁতের সংখ্যা যে সংকেতের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তাকে সংকেত বা ডেন্টাল ফর্মুলা বলে মানুষের চোয়ালে চার ধরনের দাঁত থাকে। একটি সরল রেখার উপর ও নিচে বিভিন্ন প্রক দাঁতের ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষর লিখে ঐ ধরনের দাত প্রতি চোয়ালের অর্ধাংশে কয়টি আছে। অতঃপর প্রতি চোয়ালের অর্ধাংশের মোট দাঁতের সংখ্যাকে ২ দ্বারা গুণ করে উভয় চোয়ালের দাঁতের সংখ্যা যোগ করলে মোট দাঁতের সংখ্য পাওয়া যায়। এ নিয়ম অনুযায়ী মানুষের দক্ষ সংকেত হচ্ছে
I2C1P2M3 X2 =৮ X২ = ১৬ + ১৬ = ৩২
রাসায়নিক পরিপাক
শর্করা পরিপাক: লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারসে টায়ালিন ও মন্টেজ (অঃ) নামে শর্করাবিশ্রেষী এনজাইম পাওয়া যায়। এগুলো জুটিল শর্করাকে মন্টোজ এবং সামনা মন্টোজকে গ্লুকোজে পরিণত করে। টায়াদিনের ক্রিয়া মুখগহবরে শুরু হলেও এর পরিপাক ক্রিয়া সংঘটিত হয় পাকস্থলিতে।
১. জটিল শর্করা টায়ালিন → মল্টোজ ।
২. মল্টোজ → গ্লুকোজ
আমিষ পরিপাক : মুখগহবরের লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারসে কোন প্রোটিওলাইটিক এনজাইম না থাকায় এখানে আমিষ জাতীয় খাদ্যের কোন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটেনা।
স্নেহ পরিপাক: মুখগহ্বরে স্নেহজাতীয় খাদ্য পরিপাকের জন্য কোন এনজাইম না থাকায় এধরনের খাদ্যের কোন পরিপাক ঘটেনা।
লালামিশ্রিত, চর্বিত ও আংশিক পরিপাককৃত শর্করা গলবিল ও অন্ননালির মাধ্যমে পাকস্থলিতে পৌঁছায় ।
পাকস্থলিতে খাদ্য পরিপাক (Digestion in Stomach)
পাকস্থলিটি ডায়াফ্রামের নিচে উদরের উপরের অংশে অবস্থিত প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা ও ১৫ সেন্টিমিটার চওড়া বাঁকানো থলির মতো অংশ । একে কয়েকটি অংশে ভাগ করা যায়, যথা:
যে অংশে অন্ননালি উন্মুক্ত হয় তা কার্ডিয়া (cardia)।
কার্ডিয়ার বাম পাশে পাকস্থলি প্রাচীর যা গম্বুজাকার ধারণ করে তা ফানডাস (fundus )
ডান অবতল ও বাম উত্তল কিনারা যথাক্রমে ছোট ও বড় বাঁক অংশটি ডিওডেনামে উন্মুক্ত হয়েছে তা হচ্ছে পাইলোরাস (pylonus)
কার্ডিয়াক ও পাইলোরিক অংশে একটি করে বৃত্তাকার পেশিবলয় আছে। এদের যথাক্রমে কার্ডিয়াক ও পাইলোরিক স্ফিংক্টার বলে।
যান্ত্রিক পরিপাক
মুখ থেকে চর্বিত খাদ্য অন্ননালিপথে পাকস্থলিতে এসে ২-৬ ঘন্টাকাল অবস্থান করে । এসময় প্যারাইটাল কোষ থেকে HCI ক্ষরিত হয়ে খাদ্য বাহিত অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে দেয়। চেমসণ পেশির ৩টি স্তর নিয়ে পাকস্থলি গঠিত। পেশিস্তর বিভিন্ন দিকমুখি হওয়ায় পাকস্থলি প্রাচীর নানাদিকে সঞ্চালিত হয়ে (মোচড় দিয়ে, সংকুচিত হয়ে কিংবা চাপা হয়ে) মুখগহ্বর থেকে আসা অর্ধচূর্ণ খাদ্যকে পিষে (paste)-এ পরিণত করে।
এসময় গ্যাস্ট্রিক জুস (gastric juice) ক্ষরিত হয়ে পাকস্থলির যান্ত্রিক চাপে পিষ্ট খাদ্যের সঙ্গে মিশে ঘন সুপের মতো মিশ্রণে পরিণত হয়। খাদ্যের এ অবস্থা কাইম (chyme) বা মন্ড নামে পরিচিত। এর উপর গ্যাস্ট্রিক অস্থি নিঃসৃত বিভিন্ন এনজাইমের পরিপাক কাজ শুরু হয়ে যায়।
রাসায়নিক পরিপাক
পাকস্থলির প্রাচীর পেশিবহুল এবং গ্যাস্টিক গ্রন্থি (gastric gland) সমৃদ্ধ। গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি এক ধরনের নলাকার গ্রন্থি এবং চার ধরনের কোষে গঠিত। প্রত্যেক ধরনের কোষের ক্ষরণ আলাদা। সম্মিলিতভাবে (গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থির ক্ষরণকে পার্শ্বিক জুস বলে। এর ৯৯.৪৫%ই পানি। গ্যাস্ট্রিন (gastrin) নামক হরমোন এই জুস ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে ।শর্করা পরিপাক : পাকস্থলি থেকে শর্করাবিশ্লেষী কোন এনজাইম নিঃসৃত হয় না। ফলে শর্করা জাতীয় খাদ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
আমিষ পরিপাক: গ্যাস্ট্রিক জুসে পেপসিনোজেন ও প্রোরেনিন নামক নিষ্ক্রিয় প্রোটিওলাইটিক (আমিষ বিশেষ এনজাইম থাকে । এ দুটি নিষ্ক্রিয় এনজাইম গ্যাস্ট্রিক জুসের HCI-এর সাথে বিক্রিয়া করে পেপসিন নামক সক্রিয় এনজাইমে পরিণত হয়। পেপসিন অম্লীয় মাধ্যমে জটিল আমিষের আর্দ্র বিশ্লেষণ ঘটিয়ে প্রোটিন পেপটোন-এ পরিণত করে। রেনিন দুগ্ধ আমিষ কেসিনকে প্যারাকেসিনে পরিণত করে।
স্নেহ পরিপাক : পাকস্থলির প্রাচীর থেকে গ্যাস্ট্রিক লাইপেজ নামক এনজাইম নিঃসৃত হয়। এটি প্রশমিত স্নেহ দুবারে ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারল-এ পরিণত করে ।
স্নেহদ্রব্য গ্যাস্ট্রিক লাইপেজ ফ্যাটি এসিড + গ্লিসারল অর্ধপাচিত এ খাদ্য ধীরে ধীরে ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করে। পাকস্থলির পাইলোরিক প্রান্তে অবস্থিত স্ফিংটার (sphincter পেশির বেড়ী যা ছিদ্রপথকে বেষ্টন করে থাকে) পাকস্থলি থেকে ডিওডেনামে খাদ্যের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে।
আরও দেখুন...